কুড়িগ্রামের উলিপুরের সরকারপাড়া ও মুসল্লিপাড়া গ্রামে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন।‘বাড়ি ছিল ওই যে কলাগাছ দেহা যায়, ওইহানে। ২৫টা বছর ধইরা বাড়ি ভাঙতাছি আর গড়তাছি। আর সহ্য হয় না। মনডা কয় গায়ে আগুন দিয়া সব শ্যাষ কইরা দেই।’ ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে নদের কিনারে দাঁড়িয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নাগর আলী (৬৪)। আগ্রাসী হয়ে ওঠা এ নদের গ্রাসে আবারও ভাঙনের মুখে তাঁর ভিটামাটি। শুধু নাগর আলী নন, তাঁর গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে। প্রতিদিনই ভিটা হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে একের পর এক পরিবার।
নাগর আলী কুড়িগ্রামের উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সরকারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এ গ্রামে ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অন্তত ১০টি পরিবার। প্রতিদিন একের পর এক পরিবারের ভিটামাটি গিলে খাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। এ ছাড়া ভাঙন হুমকিতে রয়েছে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের শতাধিক পরিবার ও ঐতিহ্যবাহী মোল্লাহাট বাজার। ভাঙন রোধে সরকারের কাছে আকুতি জানিয়ে নাগর আলী বলেন, ‘দুর্গতি হইলো আমাদের এই নদী। আমরা তো ট্যাকাপয়সা চাই না। নদীটা ঠ্যাকায় দিলেই হয়।’ উপার্জনের টাকায় খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের সুখের জন্য নতুন ঘর তুলেছিলেন দিনমজুর মোঘল হোসেন। ভাঙনে ভিটার একেবারে কাছে এসেছে ব্রহ্মপুত্র।
নদের আগ্রাসী আচরণে তিনি বুঝতে পেরেছেন শেষ রক্ষা আর হবে না। শিশুসন্তান সুমনকে নিয়ে তাই পরম যত্নে গড়া ঘরের সবকিছু খুলে নিচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন মোঘল হোসেন। মোঘল বলেন, ‘নিজে না খাইয়া কষ্টের ট্যাকা দিয়া পোলাপাইনের জন্য ঘর করছিলাম। কপালে না থাকলে কী করুম। চারবার বাড়ি ভাঙছে। শ্যাষে শ্বশুরের দেওয়া ভিটায় ঘর করছিলাম। সেটাও হারাইলাম। অহন সব লইয়া রংপুরের পীরগঞ্জের দিকে যাইতাছি।’ মোঘলের ভাঙনকবলিত ভিটার কিছুটা দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্রের কিনারে আরও কয়েক ঘর। মাঝখানে অন্তত ৫-৭টি পরিবার ঘর ভেঙে নিয়ে বিছানাপত্র রেখেছে খোলা আকাশের নিচে। ভাঙন থেকে বাঁচতে থাকার ঘর ভেঙে রান্নাঘরে বসবাস করছেন আনোয়ারা-মুসা মিয়া দম্পতি। ভাঙনে স্থানান্তরিত হতে হতে তাঁরাও ক্লান্ত। আনোয়ারা বলেন, ‘এত কুলায় না বাড়ি ভাঙা।
মাইনসের জায়গায় আছিলাম। সব ভাইঙা-চুইরা গেল। পোলাপান লইয়া অহন কই যামু জানি না।’ এদিকে কয়েক কিলোমিটার ধরে চলমান ভাঙনে বিলীন হচ্ছে শত শত হেক্টর আবাদি জমি, বাড়ছে ভূমিহীন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই ইউনিয়নের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন চলমান রয়েছে। একের পর এক পরিবার বাস্তুহারা হতে থাকলেও ভাঙন প্রতিরোধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পাউবো কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গত শুক্রবার বিকেলে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধশত পরিবার, আবাদি জমি ও গাছপালা। অনেকের বাড়ির গাছপালা নদের পানিতে পড়ে আছে।
মোল্লারহাট বাজারের দক্ষিণ প্রান্তের একটি অংশে পাউবোর জিও ব্যাগ ধসে গেছে ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে। ভাঙনের তীব্রতার কথা স্বীকার করে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আপাতত মোল্লারহাট বাজার প্রতিরক্ষায় ৫ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে বসতভিটা রক্ষায় কোনো কাজ শুরু হচ্ছে না।’