মেহেরপুর জেলায় চলতি মৌসুমে বেগুনের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠে ফলন ভালো হলেও বাজারে বেগুনের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে জেলার অসংখ্য বেগুন চাষি। শহরের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা হলেও গ্রামের পাইকারী বাজারে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরের বেশি মূল্য পাচ্ছে না কৃষকরা। মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের উৎপাদিত বেগুন বিক্রি করে হাজার হাজার টাকা লাভবান হলেও উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে হতাশ মাঠে উৎপাদনকারী কৃষক।
মেহেরপুর সদর উপজেলার বামনপাড়ার বেগুন চাষি মনিরুল জানান, ২ বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছি।
গতবারের তুলনায় এবার প্রচুর পরিমাণ বেগুন উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু সার, সেচসহ প্রতিদিন পোকা দমনে কীটনাশক প্রয়োগে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যায় করতে হচ্ছে। প্রথম দিকে পাইকারি ৪০-৪২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও এখন বাজার মূল্য অনেক কম। এতে করে বেগুন বিক্রি করে মুনাফা তো দুরের কথা আসল টাকা উঠবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
হরিরামপুর গ্রামের আব্দুস সালাম জানান, শুরুতে প্রতি কেজি বেগুনের মূল্য ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দর পেলেও গত কয়েকদিন ধরে বেগুনের মূল্যে ধস নেমেছে। স্থানীয় গ্রামের বাজার থেকে পাইকাররা ৩০ টাকা কেজি দামেও বেগুন কিনতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে শত শত মণ বেগুন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।
গাংনী উপজেলার মাইলমারী গ্রামের বেগুন চাষি ইনারুল ইসলাম জানান, ১০ কাঠা জমিতে বেগুনের আবাদ করেছি। ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করতে পারিনি। পোকার আক্রমণ ঠেকাতে ১ দিন পরপর কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। বৃষ্টির কারণে ৩ দিন কীটনাশক স্প্রে করতে বিলম্ব হওয়ায় এখন পোকাতে ভরে গেছে পুরো ক্ষেত। নতুন করে ফুলও আসছেনা।
একই গ্রামের মতিয়ার রহমান জানান, শহরের বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৪০/৪৫ টাকা দামে, এমনকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে ৯০/১০০ টাকা কেজি দরে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হলেও আমরা এখানে বেগুনের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছি না। পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে ৩০/৩২ টাকা কেজি দামেও বেগুন কিনছে না। ফলে আমাদের শ্রম আর উৎপাদন খরচ তুলতে পারবো কিনা এই নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি।
হাড়াভাঙ্গা গ্রামের ইউসুফ আলী জানান, খুচরা বাজারে বেগুনের দাম সর্বোচ্চ হলেও কৃষকরা তা পাচ্ছেনা। কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে বেগুন কিনলেও বাজারে বেশি লাভে বিক্রি করছেন। এতে করে প্রকৃত মূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকেরা।
ব্রজপুর গ্রামের চাষি আন্টু জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও লাফা জাতের বেগুন চাষ করেছি। আশানুরূপ বেগুন উৎপাদন ও দাম পেলেও হতাশার মধ্যে রয়েছি। কারণ বেগুন উৎপাদন করতে পোকা দমনে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করতে হচ্ছে। এতে করে লাভের অংশ কমে যাচ্ছে।
রামনগর মাঠে বেগুন ক্রয় করতে আসা নওদা মটমুড়ার ব্যবসায়ী শাহজাহান ও ইকরামুল বলেন, প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় বেগুন কিনে থাকি। কাঁচা বাজারের মূল্য নির্ধারিত থাকেনা। কখনও কখনও লোকসানও গুনতে হয় আমাদের। তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় বেগুনসহ অন্যান্য সবজি পাঠিয়ে থাকি।
মেহেরপুর বড়বাজার তহবাজারের মহলদার ট্রেডার্সের লিটন উদ্দীন জানান, গাংনী, বামুন্দী, ভাটপাড়া, সাহারবাটী, পিরোজপুর, কায়েম কাটা, বাওট, নওপাড়া, সাহেবনগর ও কাজীপুর বাজারসহ বিভিন্ন স্থানীয় গ্রামীণ বাজারগুলোতে সবজির বাজার বসে। তারপরও আমাদের এখানে অনেক কৃষক বেগুন নিয়ে আসে। ঢাকার বাজার কম হওয়ায় এখানেও এর প্রভাব পড়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে বেগুনসহ অন্যান্য সবজি ক্রয় করে ট্রাকযোগে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়।
মেহেরপুরের সবজির চাহিদা ঢাকার বাজারে প্রচুর থাকলেও এই অঞ্চলের কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে হয়তো বা সবজির উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। বেতবাড়ীয়া গ্রামের বেগুন চাষি তুহিন, সুমন, কোমল, রহিদুলসহ আরো কয়েকজন মেহেরপুর সমাচারকে জানান, ক্ষেত থেকে বেগুন তুলে বাজারে নিয়ে আসার পর দাম যেমনই হোক আমরা বিক্রি করতে বাধ্য থাকি। কারণ গাছ থেকে বেগুন তুলে ২/১ দিন সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই।
বেগুন সংরক্ষণ করার মত কোন হিমাগার না থাকায় বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে পাইকাররা অনেকটা আমাদের জিম্মি করে কম দামে বেগুন বিক্রি করতে বাধ্য করে। তারা শহরে নিয়ে প্রতি কেজি বেগুন ৬০/৭০ টাকা দামে বিক্রি করলেও আমাদেরকে ৩০ টাকা দাম দিতেও তাদের অনিহা। ফলে বেগুন উৎপাদন করে আমরা হতাশ।