ঢাকা, ০১ ডিসেম্বর- নতুন সড়ক পরিবহন আইনে একজন চালকের লাইসেন্সে থাকবে ১২ পয়েন্ট। ট্রাফিক আইন অমান্য করে একবার মামলা খেলে চালক হারাবেন এক পয়েন্ট। এভাবে একে একে ১২টি মামলা খেলে বাতিল হবে তার লাইসেন্স। এরপর আর কখনও বাংলাদেশি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন না তিনি। শেষ হয়ে যাবে একজন চালকের পেশাগত জীবন।
অথচ আইনের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিষয়ে জানেন না গণপরিবহনের চালকরা। এমনকি রাইড শেয়ারিং অ্যাপের রাইডার কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িচালকরাও জানেন না এ পয়েন্টের ‘খেলা’। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ঢাকার চার লেগুনার চালক, পাঁচজন রাইড শেয়ারিং অ্যাপের রাইডার, ১২ জন বাসচালক, দুজন মাইক্রোবাসচালক এবং ছয় প্রাইভেটকারের চালকের কাছে পয়েন্টের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তারা ‘কিছুই জানেন না’, ‘শোনেননি’ বলে মন্তব্য করেন। চালকদের সচেতন না করেই আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
পয়েন্ট কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে গুলিস্তান থেকে চকবাজার রুটের লেগুনাচালক আশরাফ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আইন-ই তো বুঝি না। শুধু শুনছি, পুলিশ ধরলে পাঁচ হাজার, ১০ হাজার টাকার মামলা দেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাগো সব কাগজপত্র ওকে আছে (ঠিক আছে)। তাই আইন লইয়া চিন্তা করি না।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে উবার মোটরসাইকেল চালক শফিউল্লাহ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পত্র-পত্রিকায় দেখে যা বুঝলাম, অনেক সচেতনভাবে গাড়ি চালাতে হবে। কিন্তু পয়েন্টের বিষয়ে এখন পর্যন্ত শুনি নাই। ১২ পয়েন্ট কাটলে লাইসেন্স বাতিল হবে- এমনটাও জানি না।’
রমজান হোসেন নামে মগবাজার এলাকার এক প্রাইভেটকারের চালক বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে জানা নেই।’
চালক তো দূরের কথা, খোদ যারা মামলা দেবেন তারাও জানেন না কবে থেকে কীভাবে কাটা হবে এ পয়েন্ট! এমনকি আদৌ কাটা হবে কি-না?
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তর বিভাগের দুজন এবং দক্ষিণ বিভাগের দুজন সার্জেন্টের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কেউই পয়েন্ট কেটে মামলা দেয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির উত্তর ট্রাফিক বিভাগের এক সার্জেন্ট সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের এখন পর্যন্ত পয়েন্ট কাটার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। সার্জেন্টদের নিয়ে যেসব ওয়ার্কশপ বা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, সেগুলোতে শুধুমাত্র ধাপে ধাপে জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। যদি অপরাধ গুরুতর হয় তাহলে শুনানির জন্য তাকে ডিসি অফিসে ডাকতে বলা হয়েছে। তবে পয়েন্ট নিয়ে কী হবে, তা এখনও জানানো হয়নি।’
ট্রাফিক উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) প্রবীর কুমার রায় এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘নতুন আইন সম্পর্কে ডিএমপি থেকে যে ধরনের নির্দেশনা আসবে আমরা সেই অনুযায়ী মামলা দেব।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘চালক, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে কীভাবে পয়েন্ট কাটার ধারাটি প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করব। তবে শাস্তি আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, আমরা চাই সবাই আইন মেনে চলুক। পয়েন্ট কাটা শুরুর আগে এ বিষয়ে আরও প্রচারণা করা হবে।’
সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞরা জানান, উন্নত বিশ্বে ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে এমনভাবে পয়েন্ট কাটার বিধান রয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী ১২ পয়েন্ট কাটা হলে শুধুমাত্র চালকের লাইসেন্স বাতিল হবে। উন্নত বিশ্বে এ আইন আরও কঠোর। ১২ পয়েন্ট বাতিলে একজন নাগরিক লাইসেন্স ছাড়াও সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। একইভাবে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণও পাবেন না।
তাদের ভাষ্য, আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। উন্নত বিশ্বে গণপরিবহনের চালকরা শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা যেকোনো আইনের বিষয়ে নিজেরাই আগাম জ্ঞান রাখেন ও সচেতন হয়ে যান। তবে বাংলাদেশের চালকরা তেমন শিক্ষিত নন। তাই সরকারের উচিত বাধ্যতামূলকভাবে তাদের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেয়া।’
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ইলিয়াস কাঞ্চন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ পদ্ধতি উন্নত বিশ্বে রয়েছে। আশা করছি, এটা কাজে দেবে। প্রথম দিকে পয়েন্ট না কাটা হলেও আইন অমান্য করলে জেল-জরিমানা করা হবে। তবে সবার আইন মেনে চলা উচিত।’
যেসব অপরাধে চালকের পয়েন্ট কাটা যাবে
১। গণপরিবহনে ভাড়ার চার্ট প্রদর্শন না করলে বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি কিংবা আদায় করলে এক মাসের জেল, ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি চালকের এক পয়েন্ট কাটার বিধান রয়েছে।
২। কন্ট্রাক্ট ক্যারিজ মিটার অবৈধভাবে পরিবর্তন বা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি বা আদায়-সংক্রান্ত অপরাধে ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ছাড়াও চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা হবে।
৩। গাড়িতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোড নিলে ৮৬ ধারায় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা, এক বছরের জেল ও দুই পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।
৪। চালক বেপরোয়া গাড়ি চালালে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার এক পয়েন্ট কাটা হবে।
৫। ঝুঁকিপূর্ণ যান চালিয়ে পরিবেশ দূষিত করলে এবং ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালালে (যেমন, হেড লাইট নষ্ট) এমন অপরাধেও জরিমানার পাশাপাশি এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
৬। নেশাজাতীয় দ্রব্য পান, চলন্ত অবস্থায় মোবাইলে কথা বললেও জেল-জরিমানার পাশাপাশি এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
৭। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে চালক বা কন্ডাক্টর যদি থাকে এবং ফায়ার সার্ভিসকে খবর না দেয়; আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে, তাহলে জেল-জরিমানার পাশাপাশি এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
সূত্র: জাগোনিউজ