কুড়িগ্রামের উলিপুরে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশ বান্ধব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী তালগাছ। এক সময় গ্রামবাংলার অধিকাংশ বসতভিটা, বাড়িতে, রাস্তায় ও মাঠে প্রচুর পরিমাণ তালগাছ দেখা যেতো। কালের পরিক্রমায় এখন হারিয়ে যেতে বসেছে তালগাছ। এখন আর তেমন দেখা মেলে না তালগাছের। বাবুই পাখির বাসা ও হাজার হাজার বাবুই পাখির কিছির-মিচির ডাকের মনোরম দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে ক্রমবর্ধমান মানুষের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য বনভূমির গাছ কেটে সাবার করে ফেলছেন। তার সাথে সাথে তালগাছও ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বজ্রপাতে প্রাণহানীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেশ বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে তালগাছের সংখ্যা কমে আসা। তাই পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষাসহ অন্যান্য উপকার পেতে তালগাছের চারা রোপণ ও সুরক্ষা করা ভীষণ জরুরি।
এদিকে তালগাছ কমে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে পুষ্টি সমৃদ্ধ মৌসুমি ফল তালশাঁসের উৎপাদন। বাড়ছে বজ্রপাতের ঝুঁকি। পুষ্টি সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে তালশাঁসের কদর বাড়ছে। বর্তমানে অনেকেই তালের আঁটি রোপণ করে তাল গাছ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি বজ্রপাত রোধে বিভিন্ন রাস্তার ধারে তালগাছ রোপণ করছেন এলাকাবাসী ব্যাক্তিগত উদ্যোগে।
তালের পিঠা, তালের গুড়, তালের রস সব মানুষের খুব মজাদার খাবার। বিশেষ করে অতীত সময়গুলোতে গ্রাম-বাংলায় তালের পিঠা ছাড়া আত্মীয়তা কল্পনাই করা যেত না। এছাড়া তাল গাছের পাতা দিয়ে তৈরি হয় নানা রকমের হাতপাখা।
জানা যায়, তালের শাঁসে ৯২ শতাংশই জলীয় অংশ। এতে আছে ক্যালরি, শর্করা, ক্যালসিয়াম, খনিজ, ভিটামিন সি। সকল বয়সের মানুষকে তালশাঁস খাওয়া প্রয়োজন। এ তালগাছ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাবার পথে। বর্তমান প্রজন্মকে তাল গাছের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত করলে এবং সরকারি ভাবে উদ্যোগ নেয়া হলে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য তাল গাছ হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। এখনও দুই একটা তাল গাছ গ্রাম-গঞ্জের ঝোপ-ঝাড়ে দেখা গেলেও তা রক্ষায় নেই তেমন কোনো উদ্যোগ।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রবীণেরা জানান, আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তালের গাছ দেখা যেতো। কিন্তু এখন আর তেমন চোখে পড়েনা। প্রায় বিলুপ্তির পথে তাল গাছ। বাজারে তাল চোখে পরার মতো ছিলো। প্রায় বাড়িতে তালের পিঠে খাওয়া হতো। বর্তমানে বাজারে পাকা তাল দেখা তেমন মেলেনা। তাছাড়া এখন গ্রামীণ জনপদে যেসব তাল গাছ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু গাছ লাগানো হলেও মূলত বেশিরভাগ তাল গাছ বেড়ে ওঠে প্রাকৃতিকভাবে অযত্ন-অবহেলায়। আর এসব গাছ থেকে যুগে যুগে মানুষ ভোগ করেছে সুস্বাদু ফল ও রস।
উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের হারুনেফড়া গ্রামের খলিফার মোড় এলাকার তাল চাষি আশরাফ আলী জানান, বহু বছর আগে বসত বাড়িতে জমির উঁচু এলাকায় তালের গাছ দেখা যেতো। কিন্ত কালের বিবর্তনে তালগাছ সহ বিভিন্ন ধরনের গাছ কেটে উজাড় করে দিয়ে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি তৈরি করেছেন। এখন আর তালগাছ চোখে পড়েনা। তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ির আঙ্গিনায় তালের গাছ লাগিয়েছি। অনেক যত্ন করে তা বড় করেছি। ক্যালরি, শর্করা, ক্যালসিয়াম, খনিজ ও ভিটামিন সি যুক্ত তাল আসা শুরু হয়েছে। আশা করছি ভিটামিন যুক্ত তালের শাঁস পারিবারের চাহিদা পুরন করেও বাজারজাত করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
উলিপুর পৌর বাজারে বিভিন্ন এলাকায় তালশাঁস বিক্রেতা মোশারফ হোসেন জানান, আমি প্রতিবছরই তালের শাঁস বিক্রি করে সংসার পরিচালনা করি। এলাকাভিত্তিক তাল না পাওয়ায় উপজেলার বাহিরে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি দরে তাল ক্রয় করে এনে শাঁস বিক্রয় করে থাকি। তিনি এলাকায় তাল পাওয়া গেলে বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হত না।
উলিপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আশরাফুজ্জামান জানান, তালগাছের অনেক উপকারিতা রয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাল গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী তালগাছ টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলেরই প্রয়োজন। অতীতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তাল গাছ দেখা গেলেও এখন আর তেমন চোখে পরে না। তালগাছ একদিকে ছায়া দেয় ও শোভাবর্ধন করে। আবার তালের শাঁসে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুন। উপকারী তাল গাছ টিকিয়ে রখার জন্য বেশি বেশি করে তালের চারা রোপন করতে বলেন তিনি।
উপজেলা বন কর্মকর্তা ফজলুল হক জানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী বৃক্ষ তালগাছ টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলেরই প্রয়োজন। এ উপকারী বৃক্ষটি যেমন পরিবেশ বান্ধব তেমনি সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তাই সামাজিক ও ব্যাক্তিগত ভাবে বেশি বেশি করে তালের চারা রোপণ করতে হবে বলে জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মোঃ মোশারফ হোসেন জানান, তালশাঁসের বেশির ভাগ অংশ জলীয় হওয়ায় শরীরে পানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম এ ফল । কোন কারণে দ্রুত শরীর পানিশূন্য হশে যায় সেটিও পূরণ করতে পারে এই তালের শাঁস। তালশাঁসে ভিটামিন ‘এ’ ভিটামিন ‘বি’ ভিটামিন ‘সি’ আছে। প্রচন্ড গরমে তালের-শাঁসে শরীর দ্রুত শীতল করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হয়ায় শরীরের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। এজন্য হারিয়ে যাবার পথে তালগাছ বেশি বেশি করে রোপন করার কথা বলেন তিনি।