একসময় মেহেরপুরের সকল গ্রামাঞ্চলের পথে, পুকুরের পাড়ে, ক্ষেতের আইলে, বাড়ির পাশেসহ ঝোপঝাড়ে সারি সারি দেখা যেতো খেজুর গাছ, কিন্তু এই খেজুর গাছ আজ বিলুপ্তি পথে। শীতের সকাল আর খেজুরের রস দু’য়ে মিলে ছিল একাকার। কালের বির্বতনে এখন আর সে চিত্র চোখে পড়ে না। নেপথ্যে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলি। কিছু অসাধু চক্র ইটভাটায় প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন খেজুর গাছ যার ফলে আজ বিলুপ্তির পথে খেজুর গাছসহ খেজুর গাছের রস।
বিগত কয়েক বছর পূর্বেও জেলার মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের কিছু মানুষ বিকেল হলেই ধারালো হাঁসুয়া বা দা কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে এ গাছ থেকে ও গাছের মাথায় রাজত্ব করে বেড়াতো। গাছি তার মনের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পের মতো করে খেজুর গাছের গলায় দা চালিয়ে দিতেন এবং মাটির কলসি (ঠিলি) বা ঘটি বেঁধে চলে আসতেন।
পরের দিন সকাল বেলা ঘটি ভর্তি রস নিয়ে নিচে নেমে আসতেন এবং এই রস বিক্রি করে সংসারের যাবতীয় খরচ নির্বাহ করতেন। কেউ কেউ কাঁচা রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করে বিক্রি করতেন। এভাবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে খেজুর রসের একটি চিরাচরিত সম্পর্ক স্থাপন হতো। তখন কৃষকের ঘরে উঠতো নতুন ধান। খেজুরের রস আর নতুন ধান গ্রাম-বাংলার মানুষের মধ্যে নবান্নের উৎসবে মাতোয়ারা করে রাখতো। নতুন ধানের পিঠা আর খেজুরের রস শীতের সকালকে করে রাখতো মধুময়। ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েসের ধুম চলতো।
সময় বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে মানুষের জীবন প্রণালি। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রচলিত সংস্কৃতি। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য ও ইটভাটায় জ্বালানির দাপটে আশ-পাশের খেজুর গাছসহ অন্যান্য গাছ কেটে ফেলছে আবার কেউ কেউ কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে বিদেশি গাছের বাগান করছেন। এতে শীতের সকালে খেজুরের রসের স্বাদ আস্বাদন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রামের মানুষ।খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এ অঞ্চলে এখন খেজুরের রস ও গুড় দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। মন চাইলেও এখন আর যেখানে সেখানে কাঁচা রস পাওয়া সম্ভব হয় না। টাটকা রস পাওয়া বড়ই মুশকিল ব্যাপার।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি), দুপুর থেকে সন্ধা অবধি সরেজমিনে গাংনী উপজেলার পূর্ব মালশাদহ-ধানখোলা ও পশ্চিম মালশাদহ-হিন্দা সড়কের ঢাকা ব্রিকস, সোনালী ব্রিকস, হানিফ ব্রিকস, স্টার ব্রিকস, সুপার ব্রিকস, বলাকা ব্রিকস ও কালুর ভাটা নামে পরিচিত কয়েকটি ইটভাটা ঘুরে দেখা যায় কয়েকটি ভাটাতে খেজুরের গাছ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে পূর্ব মালশাদ-ধানখোলা সড়কে ঢাকা ব্রিকস এ যা দেখা গেছে তা অবিশ্বাস্য! সেখানে স্তুপ করে রাখা জ্বালানির অধিকাংশই খেজুরের গাছ। আর পাশেই বসানো হয়েছে কাঠ ফাড়াইয়ের করাত কল।
প্রাচীন ঐতিহ্য এভাবে পুড়ানো হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনারা জানান, অনেক বাড়ির পাশে পুরনো সু-উচ্চ গাছ রয়েছে যে গাছ থেকে রস সংগ্রহ সম্ভব নয় মুলতঃ তারাই এসব গাছ কর্তন করে ভাটাতে বিক্রি করে থাকে। তিনারা জানান, বছরে ৫ লাখ টাকা সরকারকে ভ্যাট দিয়ে ভাটা চালাচ্ছি। সারাদেশেই এমনটি চলছে, পারলে সারাদেশের সকল ইটভাটা একযোগে বন্ধ করে দিক। এসময় তিনারা আরও জানান, প্রতিদিন অসংখ্য সাংবাদিক ইটভাটাতে এসে টাকা নিয়ে যায়। ডিসি স্যার বলেছেন, সাংবাদিক আসলে তিনার কাছে পাঠিয়ে দিতে।
এ বিষয়ে মেহেরপুর জেলা প্রশাসককে ফোন করা হলে তিনি জানান, ইটভাটাতে স্তুপ করে রাখা খেজুর গাছের ছবিগুলো তুলে এবং বিস্তারিত জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
এদিকে পশ্চিম মালশাদহ-হিন্দা সড়কের মালশাদহ থেকে হিজলবাড়ীয়া সড়কের অধিকাংশ জায়গায় ইটভাটাতে মাটি বহনের ফলে পাকা সড়কে মাটি পড়ে বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা পাকা সড়ক নাকি কাঁচা। একটু বৃষ্টি হলেই ঘটে অসংখ্য দুর্ঘটনা। এসড়কে চলাচলকারীদের অনেকেই জানান, হিন্দা পার হয়ে হিজলবাড়ীয়া থেকে মালশাদহ যাবার পর মাটিবাহী যানবাহনের দাপটে শরীরের পোশাক আশাক ধুলোবালির কারণে আর ব্যবহারের উপযোগী থাকেনা। তাছাড়া রাস্তার মাটিতে লক্কর ঝক্কর করে মোটরসাইকেল নিয়ে আসতে হয়। এব্যাপারে হিজলবাড়ীয়া গ্রামের বলাকা ব্রিকস এর পক্ষ থেকে বলা হয়, এর আগে একবার রাস্তা ধোয়া হয়েছিল, শুক্রবার আরেকবার ধুতে হবে। তাছাড়া পানি দিয়ে রাস্তার মাটি পরিষ্কারের কারণে পিচ্ছিল হলে অনেকে অভিযোগ করে বলেও তিনি জানান।
তবে এসড়কের ঝঞ্ঝাট দূরীকরণে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সড়কে চলাচলকারী ভুক্তভোগী জনগণ।